জেরিকো সভ্যতা Jericho civilization


 জেরিকো সভ্যতা

(Jericho civilization)

বৃহত্তর প্যালেস্টাইন অঞ্চলের বিকশিত একটি প্রাচীন সভ্যতা। প্রাচীন জেরিকো নামক নগরের নামানুসারে এই নগরীর নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমানে নগরকে বলা হয় তেল এস-সুলতান (Tell es-Sultan)।

হিব্রু এরিহো শব্দ থেকে জেরিকো শব্দের উৎপত্তি। এরিহো শব্দটি এসেছে রিয়াহো থেকে। যার অর্থ হলো সুগন্ধ। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা মনে করেন, জেরিকো শব্দটি এসেছে হিব্রু ইয়ারিয়াহো শব্দ থেকে। যার অর্থ চন্দ্র। আরবি ভাষায় জেরিকো শব্দের অর্থ হলো চাঁদের শহর বা চন্দ্রনগরী। বর্তমান এটি জাতিসংঘের বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে সংরক্ষণের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এই অঞ্চলকে প্রাচীন ইস্রায়েল সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জেরিকা ছিল এই সাম্রাজ্যের সর্ব-দক্ষিণ অঞ্চল। এর দক্ষিণে ছিল জুদাহ সাম্রাজ্য, মোয়াব সাম্রাজ্য এবং মৃত সাগর, পূর্বে ছিল আম্মান সাম্রাজ্য।

বর্তমান জর্ডান নদীর পশ্চিম প্রান্তে জেরিকোর অবস্থান ছিল। হিব্রু বাইবেলে জেরিকো-কে বলা হয়েছে 'তালগাছের শহর'। এই নগরীর পতন হয়েছিল সেমেটিক হিব্রুভাষী ইস্রায়েল জাতির আক্রমণে।

এই অঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সূত্রে জানা যায় জানা যায় যে, ১২,৫০০ থেকে ১০,০০০

খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে একদল শিকারী মানবগোষ্ঠী বসবাস শুরু করেছিল। এই মানবগোষ্ঠীকে সাধারণভাবে নাটুফিয়ান সংস্কৃতির মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই সময় পৃথিবীর শেষ বরফযুগের অন্তিম দশায় ছিল। ৯৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই বরফযুগ শেষ হয়ে যায়। ফলে সেকালের প্যালেস্ট্যান অঞ্চল বেশ উষ্ণ হয়ে উঠেছিল। ৯০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে জেরিকো অঞ্চলে কিছু মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছিল। এর ভিতর দিয়ে জেরিকো সভ্যতার শুরু হয়েছিল।

এরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ৮০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে ৪০ হাজার বর্গমিটার জুড়ে, মাটির ইট দিয়ে নগরপ্রাচীর নির্মাণ করেছিল। এর উচ্চতা ছিল ৩.৬ মিটার (১১.৮ ফুট)। কোনো গবেষকদের মতে এর উচ্চতা ছিল প্রায় ৪ মিটার (১৩ ফুট)। এর প্রস্থ ছিল ১.৮ মিটার (৫.৯ ফুট। এই প্রাচীরে অভ্যন্তরে একটি পাথরের টাওয়ার ছিল। এর উচ্চতা ছিল ৮.৫ মিটার (২৮ ফুট) এবং ভিত্তিভূমির প্রস্থ ছিল ৯ মিটার (৩০ ফুট)। এর ভিতরে ছিল ২২টি ধাপের সিঁড়ি। ধারণা করা হয়, এই টাওয়ারটি এরা নির্মাণ করেছিল বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবে এই টাওয়ারটি ব্যবহৃত হতো।

এই নগরীর জন্য সংখ্যা ৩ শত থেকে ৩ হাজারের ভিতরে ছিল। প্রথম দিকে এরা শিকারী থাকলেও পরে ধীরে ধীরে কৃষিকাজ শুরু করেছিল। এদের উৎপাদিত শষ্যের তালিকায় ছিল গম, বার্লি এবং লেগুম জাতীয় বীজ।

৭০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই অঞ্চলে অন্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষের আবর্ভাব ঘটে। এর আদিবাসীদের ঘরবাড়ি দখলের সাথে সাথে- এই অঞ্চলের সংস্কৃতি গ্রহণ করে। সেই সাথে এরা কৃষিকাজে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। সম্ভবত এই সময় এরা কৃষিকাজের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বৃক্ষরোপণ করা শুরু করে। শস্য সংরক্ষণের জন্য এদের শস্যাগার ছিল।

ধারণা করা হয়, এদের সময় মানুষের এরা গৃহপালিত পশুর তালিকায় ভেড়া অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ধীরে ধীরে ভেড়াকে এরা অন্যতম পশুসম্পদে পরিণত করে। তবে এরা ঐতিহ্যগতভাবে শিকারও করতো।

এরাও আদিবাসীদের মতো রৌদ্রে শুকানো ইটের ঘরের বসবাস করতো। এদের বাড়ির মাঝখানে থাকতো আঙিনা। একাধিক কক্ষবিশিষ্ট ঘরে ব্যবহার এই সময় থেকে শুরু হয়েছিল।

ধারণা করা হয়, এরা গোড়ার দিকে শস্য এবং পশুর জন্য ঘর তৈরি করলেও নিজেরা বসবাসের জন্য ঘরের ভিতরে কাটানো পছন্দ করতো না। কারণ এই সভ্যতার শেষের দিকে তাদের গৃহপালিত পশুর প্রতি যত্ন নিতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৮৫০০ অব্দের দিকে এরা বসবাসের জন্য ঘরের ভিতরভাগকে সুরক্ষিত করা শুরু করেছিল। এরা সাধারণ পাথর, চুন, গ্রানাইড জাতীয় উপাদান মিশিয়ে ঘরের শক্ত মেঝে তৈরি করতো। দেওয়ালে এরা কাদা ব্যবহার করতো। অন্যান্য ঘরের চেয়ে রান্না-ঘর অপেক্ষাকৃত ছোটো ছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫০০ অব্দের দিকে এরা পুরোপুরি গৃহীতে পরিণত হয়েছিল। চুনাপাথরের চূর্ণ দিয়ে থেকে পাত্র তৈরি করা শিখেছিল এই সময়ে। এরা প্রথমে নরম চুনাপাথরের চূর্ণ দিয়ে পাত্র তৈরি করে, তারপর পুড়িয়ে তা শক্ত করতো।

এরা মৃতদেহ কবর দিতো। তবে মৃতের খুলি ঘরে সংরক্ষণ করতো। এরা নানা ধরনের পাথরের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতো।

জেরিকোর ধ্বংসাবশেষ

বাইবেলের তথ্যসূত্র (জোশুয়া গ্রন্থ) অনুসারে অনুমান করা হয় যে, ১৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, ইস্রায়েল সাম্রাজ্যের রাজা জোশুয়া জর্ডন নদী অতিক্রম করে কনান অঞ্চলে প্রবেশ করে। এরা জেরিকোর প্রতিরক্ষা দেওয়াল ধ্বংস করে, জেরিকো দখল করে নেয়। অবশ্য ভূমিকম্পের কারণে পরে এর পুরো দেওয়ালই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মূলত ইস্রায়েলদের দখলের মধ্য দিয়ে জেরিকো সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটেছিল।

রোমান শাসনামলে মার্ক অ্যান্টনি তার প্রিয়তমা ক্লিওপেট্রাকে জেরিকো শহরটি উপহার হিসেবে প্রদান করেছিলেন। ক্লিউপেট্রার আত্মহত্যার পর অগাস্টাস সিজার শহরটির দায়িত্ব নেন। নানা গোষ্ঠীর হাতবদল হয়ে- ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে জেরিকো জর্ডানের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শহরটি জর্ডানের অধিনে ছিল। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে শহরটি ইসরাইল দখল করে নেয় এবং এখন পর্যন্ত এই নগরটি এদের দখলেই আছে। এটি বর্তমানে ইসরাইল সরকারের আওতাধীন জেরিকো গভর্নরেটের প্রশাসনিক আওতায় নিয়ন্ত্রিত। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে জেরিকোর লোকসংখ্যা ছিল ১৮৩৪৬। বর্তমানে লোকসংখ্যা ২০৩০০।

Comments