হাওর অঞ্চল Haor Region
সাধারণভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে, সম্মিলিতভাবে হাওর অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। উত্তরে ভারতের মেঘালয়, পূর্বে আসাম এবং দক্ষিণে ত্রিপুরা-মিজোরামের পার্বত্যাঞ্চলের ঢালে অবস্থিত এ অঞ্চল দেশের অন্য সমতল অঞ্চলের চেয়ে সামান্য নিচু প্রকৃতির। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ অঞ্চলের উচ্চতা প্রায় ৪-৫ মিটার। আয়তনের দিক দিয়ে ছোট হলেও এই বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি বৈচিত্রপূর্ণ। বাংলাদেশের হাওর হচ্ছে এই বৈচিত্রের অন্যতম ভূ-প্রকৃতি। হাওর হচ্ছে এক বিশেষ ধরণের জলাভূমি। প্রতি বছর বর্ষায মৌসুমে এবং কখনোবা আগাম বন্যায় হাওরগুলো প্লাবিত হয়। বছরের কয়েকটি মাস এ অঞ্চল গভীর পানিতে নিমজ্জিত থাকে। চারপাশে যে দিকে চোখ যায়, শুধু কূল-কিনারহীন পানি আর পানি। এর মধ্যেই অনেক দূরে দূরে ছোট্ট দ্বীপের মতো ভেসে থাকে একেকটি গ্রাম। কোথাও কোথাও এক দুটি হিজল গাছ নাক জাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কোনোমতে। এ এক অপার বিষ্ময়। বিশ্বে এমন অনন্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যময় এলাকা খুবই বিরল।
বঙ্গোপসাগর থেকে উৎসারিত বিশেষ ধরণের মৌসুমি বাষ্পপূর্ণবায়ু এবং উজানে হিমালয় পর্বতমালার বাধাজনিত কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় ভারতের চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে; হাওর অঞ্চল তার মাত্র কয়েক কিলোমিটার ভাটিতেই অবস্থিত। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৮টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে ভারতের মেঘালয়, আসাম, মনিপুর ও মিজোরাম অঞ্চলের বৃষ্টির জলের একটি বড় অংশ এবং দেশের হবিগন্জ, মৌলভীবাজার, কিশোরগন্জ, নেএকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলের মধ্য সংগৃহীত বৃষ্টির জলের সবটুকুই ভৈরব দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা নদী হয়ে সমুদ্রে পতিত হয়। হাওরাঞ্চলের ১.৯৯ মিলিয়ন হেক্টর ভূমির প্রায় ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২১ লাখ একরজুড়ে রয়েছে ছোট-বড় ৩৭৫টি হাওর, যা অধিকতর নিচু প্রকৃতির। এলাকাবাসী এসব হাওরকে আলাদা আলাদা নামে ডাকলেও বৃষ্টিপাতের মৌসুমের প্রায় পাচ-ছয় মাসজুড়ে এই সব হাওর মিলে একটিমাত্র বিশাল জলাভূমিতে পরিণত হয়। পৃথিবীর বিরলতম, বৃষ্টিজলের এই বিপুল জলরাশির সায়রকে (সাগর) আঞ্চলিক ভাবে ভাটি এলাকার ভাষায় হাওর বলে অভিহিত করা হয়।
হাওরগুলো মূলত সুদূর অতীতে ভূ-আলোড়ন বা ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট। কয়েকটি হাওর আবার বন্য প্রতিরোধী বাঁধের ভেতরে পড়েও তৈরি হয়েছে। আকৃতির দিক দিয়ে হাওরগুলো সাধারণত গোলাকৃতির, অনেকটা গামলার মতো। বর্ষা শেষে আস্তে আস্তে হাওরের পানি নেমে যেতে থাকে। ভেসে উঠতে থাকে হিজলবন আর ফসলি জমি। কিছু জায়গা অবশ্য কখনোই শুকায় না। সারাবছর পানি থাকে। এগুলোকে বিল বলা হয়। হেমন্তের শেষে জেগে উঠা জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়। এটিই হাওর অঞ্চলের একমাত্র ফসল। অন্যদিকে বর্ষায় দিগন্ত বিস্তৃত হাওরে যে মাছেরা ভেসে বেড়ায়, বর্ষা শেষে সেগুলো হাওরের বিলে এসে আশ্রয় নেয়।
ব্যাপক জীববৈচিত্র্য ধারণ এবং প্রাকৃতিক কারণে স্থায়ী ও পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থল হিসেবে হাওরগুলো সুপরিচিত। বন্যার পানি চলে যাওয়ার পর হাওরে প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন প্রকার ছোট-বড় মাছ, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে জেগে ওঠে পশুচারণভূমি। হাওর এলাকা অতিথি পাখিদের আগমনে জীববৈচিত্র্যময় হয়ে উঠে। বিচিত্র ধরনের জলজ পাখিসহ অসংখ্য হাঁসের আবাসস্থল ছাড়াও বহু বন্য প্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল এইসব হাওর। এই জলাভূমির বনাঞ্চলে একসময় জলসহিষ্ণু উদ্ভিদ, যেমন- হিজল (Barringtonia acutangula), করচ (Ponogamia pinnata), বরুণ ( Crataeva nurvala), ভুই ডুমুর ( Ficus heterophyllus), জলডুমুর (এক ধরনের Ficus ), হোগলা ( Typha elephantina) নল (Arundo donax), খাগড়া (Pharagmites karka), বনতুলসী (Ocimum americanum), বলুয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে জন্মাত।
দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ মাছের জোগানও আসে হাওর-বাঁওর-বিল জাতীয় জলাভূমি থেকে। পানির প্রাকৃতিকচক্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানও জলাভূমি। পানির দূষণ এবং দবীভূত পলি মুক্ত করতে, উদ্ভিদ জন্মাতে মিঠা পানির সরবরাহচক্রে জলাভূমির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শীতের অতিথি পাখিদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে সারাদেশে পরিচিত এ হাওর। প্রতিবছর প্রায় ২০০ প্রজাতির হাজার হাজার অতিথি পাখির অগমণ ঘটে এ হাওরে। অতীতে এ সংখ্যা ছিল আরো অনেক বেশি ছিল। বিশ্বের অনেক বিপন্নপ্রায় প্রজাতির পাখি শীতকালে অস্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তোলে এ হাওরে।
হাওরের অফুরন্ত সম্ভাবনা এখনো অব্যবহূত। শুধু ধান চাষ নির্ভরতা কমিয়ে এনে কৃষি বহুমুখীকরণ, সমন্বিত কৃষি, ফসলের নিবিড়তা বাড়ালে মানুষের আয় বাড়বে। কৃষি বিন্যাস, ফার্মিং সিস্টেম, আধুনিক যন্ত্র প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ বা বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা, বহুমুখী ব্যবহারের জন্য টেকসই পরিবহন এবং বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলা দরকার। হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুরগুলো খনন করা হলে হাওরের অধিকাংশ সমস্যার সমাধান হবে। জল, জলা ও চাষভূমি সুরক্ষায় হাওরে পরিকল্পিতভাবে সুবিধাজনক স্থানে নদী বা পুকুর খননের মাটি দিয়ে তৈরি ‘গ্রাম সৃজন’ করতে হবে।
হাওরের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাইলে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। হাওরাঞ্চলের অবস্থা, স্বতন্ত্র প্রকৃতির ধরণ, উপযোগী অবকাঠামোর বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণ, বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবক, শিক্ষক, পেশাজীবী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটি করে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করতে হবে। হাওর উন্নয়ন বোর্ডকে প্রশাসনিক, অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা দিয়ে শক্তিশালী করে গড়ে তোলতে হবে।
এছাড়াও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে হাওরাঞ্চলের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও পাঠ পরিক্রমা চালু করা যেতে পারে। শুকনা মৌসুমে হাওরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য বিশেষ ধরনণর রাস্তা নির্মাণ করা যেতে পারে। যে রাস্তা বর্ষায় পানির নিচে থাকলেও নষ্ট হবে না। শুকনো মৌসুমে হাওরাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য বিশেষ ধরনের যানবাহন ব্যবস্থা ভাবা যেতে পারে।
হাওর এলাকার বিস্তীর্ণ ফসলী জমি প্রতিবছর আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে প্রতিরোধ বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র এবং শিক্ষক ও চিকিৎসক নিয়োজিত করতে হবে। বর্ষায় ভাসমান স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যেতে পারে।
Comments